কলার উৎপাদন এবং কলা খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা
কলার উৎপাদন এবং কলা খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে আমাদের জানা প্রয়োজন। কারণ এটি আমরা প্রায়ই খেয়ে থাকি এবং আমাদের দেশের একটি সাধারণ ফল যা প্রায় বারোমাসই পাওয়া যায়। ধনী-গরিব সবাই এই ফলটি পছন্দ করেন। কলা একটি একবীজপত্রী shurb জাতীয় বর্ষজীবী উদ্ভিদ ৷ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এর বিভিন্ন জাত রয়েছে।
জাত ভেদে ইহার ফলন, রং এবং স্বাদের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয় ৷ কলার বিভিন্ন প্রকার জাত থাকার কারণে এই ফল প্রায় বারোমাসই উৎপন্ন হয়।ব্যবহারের উপরে ভিত্তি করে কলার দুইটি জাত আছে ৷ কাঁচা কলার জাত এবং পাকা কলার জাত।
ভূমিকা
কলা জন্মগত সূত্রে আমাদের এশিয়া মহাদেশের ফল/ ফসল ৷ এই কারণে বাংলাদেশে ইহার বিস্তার লাভ করা সহজ হয়েছে ৷ প্রথমদিকে অনেকেই সৌখিন হিসেবে কলার আবাদ করতেন ৷ কিন্তু বর্তমানে ইহা লাভজনক ফসলে পরিণত হয়েছে ৷ আমাদের দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু কলা চাষের জন্য খুবই উপযোগী ৷
ফলে এখানে বারোমাসই বিভিন্ন প্রজাতির কলার উৎপাদন হয় ৷ এইসব কলা আমরা সবজি হিসেবে খাই এবং পাকা কলা গুলো আমরা ফল হিসেবে খাই ৷ কলা যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিকরও বটে ৷ ইহাতে বিভিন্ন প্রকারের খনিজ পদার্থ এবং ভিটামিনের সমৃদ্ধ থাকে ৷ পটাশিয়াম কলার উপকারী পদার্থগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ৷
ব্যবহারের ধরনের উপরে ভিত্তি করে কলা প্রধানত দুই প্রকার ৷ যেমন কাঁচা কলা ও পাকা কলা৷ অর্থাৎ কিছু কলার প্রজাতি আছে যেগুলিকে আমরা কাঁচা অবস্থায় তরকারি হিসেবে খাই ৷ আর কিছু প্রজাতি আছে যেগুলো আমরা পাকার পরে খাই ৷
অনেক উপকারী গুণ থাকার পরেও দুই চারটি ক্ষতিকারক বৈশিষ্ট্য কলার ভিতরে বিদ্যমান রয়েছে ৷ আসুন কলা সম্পর্কে আমরা বিস্তারিতভাবে জেনে নেই-
কলার উৎপাদন
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উষ্ণ জলবায়ু সম্পন্ন দেশসমূহ কলার উৎপত্তিস্থল, যদিও এই ফলটি বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে চাষাবাদ করা হয় ৷ বিশ্বের বেশি কলা উৎপাদনকারী দেশ হচ্ছে ভারত ৷ দ্বিতীয় স্থানে আছে উগান্ডা ৷ তবে চীন, ভারত, বাংলাদেশ, ফিলিপিন, থাইল্যান্ড কম্বোডিয়া ভিয়েতনাম সহ এশিয়া মহাদেশে পৃথিবীর মোট ৬০% ভাগ কলা উৎপন্ন হয় ৷
ব্রাজিল এবং ইকুয়েডোরেও পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদন হয় ৷ পৃথিবীতে প্রায় ১০০০ প্রজাতির কলা আছে তার মধ্যে কেব্যান্ডিস বা সাগরকলা নামে পরিচিত কলাটি বেশি বিখ্যাত ৷ এত বিস্তর সংখ্যক প্রজাতি থাকার কারণে বারোমাসই পৃথিবীর সকল দেশে কোন না কোন প্রজাতি উৎপন্ন হয় ৷ তাই কলাকে বারোমাসি ফল হিসেবে গণ্য করা যায় ৷
বাংলাদেশ কলা চাষের সঠিক ইতিহাস বলা দুষ্কর ৷ ইতিহাসে সুস্পষ্টভাবে কোথাও কোন লিখিত প্রমাণ পাওয়া যায় না ৷ তবে পাহাড়পুরে যে বৌদ্ধ বিহার আছে সেখানে পোড়ামাটির ফলকে বেশ কিছু কলা গাছের ছবি দেখা যায় ৷ ধারণা করা হয় সেই সময় বা তার আগে থেকে এই দেশে কলার আবাদ হতো ৷
বগুড়া এবং তার আশেপাশের অঞ্চলে কলার আবাদের পরিমাণও বেশি এবং বিভিন্ন জাতের কলা আবাদ করা হয় ৷ এক সময় বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি পরিমাণে এবং ভাল মানের কলা উৎপাদিত হতো দিনাজপুর এবং মুন্সীগঞ্জে ৷বর্তমানে সেখানকার চাষীরা বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে এবং উচ্চ লাভের ফসল এসে পড়ার কারণে কলার আবাদ থেকে তারা দূরে সরে গেছে ৷
সেই জায়গাটা দখল করেছে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ এবং মেহেরপুর অঞ্চল ৷ বাংলাদেশের প্রায় সকল জেলাতেই কমবেশি কলার আবাদ হয়ে থাকে ৷এই সমস্ত কলার মধ্যে পাকা কলাই প্রায় ৯০-৯৫ ভাগ ৷ আর সবজি হিসেবে যে কাঁচা কলা খাওয়া হয় তা ৫ থেকে ১০ ভাগ ৷ যে সকল জাতের কলা আমাদের দেশে আবাদ করা হয় সেগুলোর ভিতরে সব্রী কলা, মদনা কলা, চিনি চম্পা কলা এবং কিছু পাহাড়ি জাতের কলা আছে ৷
এগুলো সবই আমাদের বংশানুক্রমিক ভাবে আবাদ হয়ে আসছে ৷ নতুন এবং সবচেয়ে ব্যবসায়িকভাবে সফলকাম এবং ফলন বেশি আর সাদে অতুলনীয় হচ্ছে সাগর কলা ৷ এটি দেশের প্রায় সকল জেলায় আবাদ হয়ে থাকে ৷ তবে মেহেরপুর রাজশাহী চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং নাটোর অঞ্চলে এই জাতটি বেশি আবাদ হয় ৷
জি-9 নামে নতুন একটি হাইব্রিড জাতের কলা গত এক দুই বছরে বাংলাদেশে বেশ একটি বড় জায়গা দখল করে নিয়েছে ৷ জাতটি যথেষ্টই ব্যবসা সফল ৷ টিসু কালচারের মাধ্যমে কিছু এই জাতের চারা উৎপাদন করা হচ্ছে ৷
লাভজনক ফসল হিসেবে কলার চাষ
প্রথমদিকে সৌখিনতার কারণে অনেকেই কলার আবাদ করতেন ৷ কিন্তু বর্তমান সময়ে অনেক ফসলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কলা অর্থনৈতিক ফসল হিসেবে নিজেরে স্থান করে নিয়েছে ৷ এর চাষাবাদ অনেক সহজ, লাগানোর পরে অঞ্চল ভেদে দুই তিনটি শেষ দিতে হয় ৷ অন্যান্য অর্থকরি ফসলের সঙ্গে তুলনা করলে এতে কম পরিচর্যা করতে হয় ৷
বাগান থেকে কলা বিক্রয় করা খুব সহজ ৷ কারণ একসঙ্গে এক হাজার বা ৫ হাজার গাছ লাগানো হলেও, সব কলা একসঙ্গে পাকে না ৷ যে গাছের কান্দিগুলি আগে পাকে, সেগুলোকে কেটে আগে বিক্রয় করা যায় ৷ ফলে চাষির জন্য কলা বিক্রয় সহজতর হয় ৷ এছাড়া দিন দিন কলার ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে ৷প্রতিনিয়ত খাওয়ার পাশাপাশি রমজান মাসে এর ব্যাপক চাহিদা বৃদ্ধি পায় ৷
বিস্কুট কেক পাউরুটি ইত্যাদিতে কিছু কিছু কলা ব্যবহার করা হয় । অনেক ফাস্টফুডের দোকানেও এর ব্যবহার রয়েছে ৷
কলার পুষ্টিগুণ এবং কলা খাওয়ার উপকারিতা
কাঁচা কলা আমাদের দেশে সবজি হিসেবে খাওয়া হয় ৷ ইহাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়রন, মিনারেল এবং অল্প কিছু ভিটামিন আছে ৷ কাঁচা কলাতে প্রোবায়োটিক ইফেক্ট আছে । যে সমস্ত কলা আমরা পাকা হিসেবে খাই, তার উপকারিতা সম্পর্কে নিম্নে বর্ণনা করা হলো-
- কলাতে বিদ্যমান পটাশিয়াম আমাদের হার্ট এবং স্নায়ুকে সচল রাখে ৷ পুষ্টি উপাদান সমূহ কে কোষে স্থানান্তরিত করে ৷ পটাশিয়াম শরীরে পানি ধরে রাখতে সাহায্য করে এবং শরীরের বর্জ্য পদার্থ বাহিরে বের করে দেয় ৷
- কলাতে পলিফেনিলিক নামক এন্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় ধমনী শক্ত হওয়া আর্থ্রাইটিস ক্যান্সার ইত্যাদি রোগের প্রতিরোধক হিসাবে কাজ করে ৷
- তাছাড়া কলাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট আছে যা খাওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে আমাদিগকে শক্তি যোগায় ৷ কলা আমাদিগকে বংশানুক্রমিক রোগের হাত থেকে রক্ষা করে ৷
- কলাতে থাকা ফাইবার এবং ভিটামিন বি-৬ রক্তে কার্বোহাইড্রেট এবং ইনসুলিন নিয়ন্ত্রণ করে থাকে
কলা খাওয়ার অপকারিতা
- অতিরিক্ত পেকে যাওয়া কলা খেলে রক্তে শর্করার পরিমাণ আবার বেড়ে যেতে পারে ৷
- বেশি পটাশিয়াম থাকার কারণে দাঁতের ক্ষতি হতে পারে ৷
- অতিরিক্ত পটাশিয়াম কিডনি রোগ তৈরি করতে পারে অথবা যারা সিকেডি বা ক্রনিক কিডনি রোগে ভুগছেন তাদের জন্য কলা খাওয়া ক্ষতিকর ৷
- শীতকালে পাকা কলা খেলে অনেক সময় ঠান্ডা লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই শীতকালে কলা খাওয়ার সময় একটু সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
লেখকের মন্তব্য
সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি কলা একটি সহজে চাষযোগ্য অর্থনৈতিকভাবে লাভবান এবং পুষ্টিকর ফল এবং সবজি ৷ প্রয়োজন মাফিক আমাদের প্রতিদিন এই ফলটি খাওয়া উচিত ৷ চাষি পর্যায়ে আবাদ বৃদ্ধির জন্য প্রচার-প্রসারণা চালানো উচিত ৷ সামান্য একটু ক্ষতিকর দিক থাকলেও সতর্কতার সহিত গ্রহণ করলে ওই সকল রোগীদের জন্য ক্ষতির কারণ হবে না ৷
তথ্যসূত্র: লেখক একজন কৃষিবিদ
তাবিনতান ব্লগের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url