সামাজিক বনায়ন এবং পরিবেশের উপর ইহার গুরুত্ব

প্রিয় পাঠক, আমরা আজকে সামাজিক বনায়ন এবং পরিবেশের উপর ইহার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করব। আমাদের ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে এবং অর্থনৈতিক জীবনে বন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সরকারি অফিস, রেল লাইন, সড়ক ও বাঁধের ধার ইত্যাদি স্থানে বনায়ন করাকে সামাজিক বনায়ন বলে। ইহা এক ধরনের সৃজিত বন।
সামাজিক বনায়ন এবং পরিবেশের উপর ইহার গুরুত্ব
সাধারণ কথায় আমরা বন বলতে বুঝি, গাছপালা ও ঝোপঝার দ্বারা পরিবেষ্টিত নির্ধারিত জায়গা। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টির প্রথম দিকেই আস্তে আস্তে বন জঙ্গল গড়ে ওঠে । এটাকে প্রাকৃতিক বন বলা হয়। প্রকৃতি তার নিজস্ব প্রয়োজনে উপাদানগুলিকে নিজের সঙ্গে অভিযোজন করে নেয়।

ভূমিকা

আমাদের চতুর্পাশে যা কিছু আছে তার সবকিছু মিলেই হচ্ছে আমাদের পরিবেশ । যেমন দালানকোঠা, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, জমিজমা, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, সাগর-মরুভূমি, গাছপালা ইত্যাদি । পরিবেশের এই সকল উপাদানের ভিতরে সকল উপাদানই সমান গুরুত্ব বহন করে না । এমন কিছু উপাদান আছে যাহা ছাড়া প্রাণীকুল চলতে পারে না বা বাঁচতে পারে না।

যেমন উদ্ভিদ কুল ছাড়া কোন প্রাণী বাঁচতে পারে না। আমরা প্রতিনিয়ত শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করছি । এই শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে আমরা যে অক্সিজেন গ্রহণ করি তাহা আসে উদ্ভিদ থেকে । সুতরাং নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে আমরা উদ্ভিদের দানের উপরে বেঁচে আছি । আবার আমরা যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃশ্বাসের সঙ্গে ত্যাগ করি তাহা গ্রহণ করে উদ্ভিদ বেঁচে আছে ।

উৎপত্তি বা সৃষ্টিগত দিক থেকে বনকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করতে পারি । যেমন প্রাকৃতিক বন এবং সৃজিত বন । প্রাকৃতিক বন-প্রকৃতিকভাবেই গড়ে ওঠে আর সৃজিত বনগুলি আমরা মানুষেরা বিভিন্ন জায়গায় তৈরি করি । সামাজিক বনায়ন ও কৃষি বনায়ন- এই সৃজিত বনের মধ্যে পরে। প্রাকৃতিক গুরুত্বের পাশাপাশি ইহার অর্থনৈতিক গুরুত্ব ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়।

একটি দেশের মোট আয়তনের তুলনায় ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু আমাদের দেশে সরকারি হিসাব অনুযায়ী মাত্র ১৬-১৭ ভাগ বনভূমি রয়েছে । তাই বনায়ন আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হিসেবে প্রতিীয়মান হয়।

পরিবেশ 

পরিবেশ হলো আমাদের চতুর্পাশে বিদ্যমান জীবিত এবং অজীবিত উপাদান যা আমাদের জীবনের উপরে এবং দৈনন্দিন কার্যকলাপের উপরে প্রভাব ফেলে। এই উপাদানগুলির মধ্যে কোনটিই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। পরিবেশের এই সমস্ত উপাদানগুলিকে মোটা দাগে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন ভূ-ভাগ- এখানে আছে সমতলভূমি, পাহাড়, মরুভূমি ইত্যাদি।

জলভাগ- যেমন সমুদ্র, মিঠাপানির নদ-নদী, পুকুর, ডোবা, যে কোন জলাশয় ইত্যাদি। পরিবেশের উপাদানগুলির আরেকটি ভাগ হচ্ছে বায়ুমণ্ডল। বায়ুমণ্ডলের অংশ হিসেবে বলা যায় যে আমরা প্রতিনিয়ত অক্সিজেন গ্রহণ করি সেটা। আবার এর একটি বড় অংশ হচ্ছে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র ইত্যাদি।জীবনের অস্তিত্বের উপর ভিত্তি করে উপাদানগুলিকে দুই ভাগে বিভক্ত।

পরিবেশের এই উপাদান গুলি হল জীবিত উপাদান এবং অজীবিত বা মৃত উপাদান। জীবিত উপাদানগুলো হচ্ছে আমরা মানুষ, গাছপালা, পশুপাখি, অনুজীব, সমুদ্রের তলদেশের মাছ, সামুদ্রিক শৈবাল ছোট বড় সকল প্রাণী ইত্যাদি। এই সমস্ত জীবিত উপাদান বাদে যে সমস্ত উপাদান গুলি আমাদের পরিবেশে বিদ্যমান সেগুলি হল অজীবিত বা মৃত উপাদান।

এই অজীবিত বা মৃত উপাদানগুলি হলো রাস্তাঘাট দালানকোঠা গাড়ি বিমান পানি মাটি ইত্যাদি। এদের প্রাণের কোন অস্তিত্ব নেই। তারপরও তারা আমাদের পরিবেশের উপাদান কারণ এদের কোনোটি ব্যতীতই আমাদের চলে না।

বনায়ন বলতে কি বুঝায়?

আমরা নিজেদের প্রয়োজনে যে বৃক্ষরোপণ করি তা হলো বনায়ন । অন্যভাবে বলা যায়, যে পদ্ধতিতে গাছ লাগানো, পরিচর্যা ও সংরক্ষণের মাধ্যমে সর্বাধিক পরিমাণে সম্পদ উৎপাদিত হয়, তাহাকে বনায়ন বলে । তবে ফসলজাত উদ্ভিদ যেমন ধান, গম, পাট, ভুট্টা এগুলো বনায়নের অংশ নয় । আকার বা সাইজের উপর ভিত্তি করে সাধারণত উদ্ভিদকে তিন ভাগে ভাগ করা হয় ।

যেমন herb বা গুল্ম জাতীয়, shurb বা ঝোপ জাতীয় এবং tree বা বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ । প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা বনে এই তিন ধরনের উদ্ভিদই দেখা যায় । তবে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এই বনজঙ্গলের ভিতরে পোকামাকড় কীটপতঙ্গ বিভিন্ন পশুপাখিও বাস করে । সাধারণত, বৃক্ষ এবং ঝোপ জাতীয় উদ্ভিদ দ্বারা বনায়ন করা হয়।

বৃক্ষ জাতীয় গাছ যেহেতু আকারে অনেক বড় হয়, তাই এই গাছ দ্বারা বনায়নের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অধিকতর লাভবান হওয়া যায়। মনুষ্যসৃষ্ট বা সৃজিত বনের ভিতরেও কীটপতঙ্গ পশুপাখি থাকতে পারে । বনায়নকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করতে পারি, একটি হলো সামাজিক বনায়ন এবং আরেকটি হলো কৃষি বনায়ন।

এই দুই ধরনের বনায়নই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে।

সামাজিক বনায়ন কি?

সমাজে যে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বসবাস করে, তাদেরকে সম্পৃক্ত করে যে বনায়ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়, তাকে সামাজিক বনায়ন বলা হয় ।তারা নিজেরা এই সমস্ত বন সৃষ্টি করে বা গাছপালা লাগায়, সেটার যত্ন করে এবং এইটা থেকে যে অর্থ আসে তা তারা ভোগ করে। সমাজে বসবাসরত দরিদ্র জনগণের অর্থনৈতিক উন্নতিই হল এই বনায়নের মূল উদ্দেশ্য।

এই ধরনের বন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ফাঁকা জায়গায়, বসতবাড়ির আশেপাশে, বাঁধ ও সড়কের ধার, পাহাড়ি অঞ্চল ও উপকূলীয় অঞ্চলে বৈজ্ঞানিকভাবে পরিকল্পিত উপায়ে সৃষ্টি করা হয়। এই বনায়ন কিছু সরকারি বিধিমালা দ্বারা পরিচালিত হয়।পাকিস্তান আমল থেকেই বনায়নের বিধিমালা ধাপে ধাপে পরিবর্তিত হয়ে আসছে।বর্তমানের এই বিধিমালাটি ২০০৪ সালে প্রবর্তিত হয় । 

তারপর ২০০৪ সাল থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে ২০১১ সাল পর্যন্ত সংশোধিত বিধিমালায় সরকারি বনভূমিতে স্থানীয় জনগণের বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে ।

পরিবেশের উপরে সামাজিক বনায়নের গুরুত্ব

ইহা নিম্নলিখিত গুরুত্ব বহন করে-

  • ভূমিহীন দুর্দশা গ্রস্থ বিধবা ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করে এবং তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে
  • পশু খাদ্য, তাদের নিজেদের খাদ্য, মূলধন, আসবাবপত্র ও আবাসন সংক্রান্ত সুবিধা গুলি নিশ্চিত করে
  • জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ সংরক্ষণ করে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা পালন করে
  • নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি করে
  • স্থানীয় নেতৃত্ব ও নারী নেতৃত্বের সৃষ্টি করা
  • পতিত জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়

কৃষি বনায়ন বলতে কি বুঝি?

একটা নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত ফসলি জমিতে বনায়ন করা, ফসল লাগানো এবং পশুপাখি পালন করাকে কৃষি বনায়ন বলা হয় । এটা মূলত একটি উন্নত ভূমি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, যার মাধ্যমে ভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়। অর্থাৎ স্বল্প পরিসরের জায়গা থেকে অধিকতর ফলন পাওয়ার জন্য কৃষি বনায়ন ব্যবহার করা হয়।

এটাকে এমনভাবে পরিকল্পনা করা হয় যাহাতে একটি উপাদান দ্বারা আরেকটি উপাদান ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।ইহাতে পরিবেশের কোন ক্ষতি হয় না এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায়। কৃষি বনায়ন কে মূলত একটি সম্মিলিত চাষাবাদ পদ্ধতি বলা যায়।

কৃষি বনায়ণের গুরুত্ব

  • ভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যায়
  • বিভিন্ন প্রকারের কার্যক্রম চালানোর ফলে ভূমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়
  • একই জায়গা থেকে একাধিক উপাদান যেমন কাঠ ফসল পশুপাখি ডিম ইত্যাদি পাওয়া যায়
  • একটি উপাদান দ্বারা আরেকটি উপাদান ব্যাহত হয় না
  • কৃষকেরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়
  • যেহেতু প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের দেশে বনভূমির পরিমাণ কম সুতরাং মোট বনভূমি বৃদ্ধি করতে কৃষি বনায়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে
  • জীববৈচিত্র সংরক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে
  • রিজেনারেটিভ কৃষিকে উৎসাহিত করে

লেখক এর মতামত

উপরের আলোচনা থেকে আমরা দুই ধরনের বনায়ন সম্পর্কে জানতে পারলাম। বন আমাদের প্রাকৃতিক, সামাজিক, জাতীয় এবং অর্থনৈতিক জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় বনের ভূমিকা অপরিসীম। জীববৈচিত্র সংরক্ষণ এবং অর্থনৈতিক মুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে কাজ করে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

তাবিনতান ব্লগের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url