টমেটোর ইতিহাস এবং টমেটো খাওয়ার উপকারিতা অপকারিতা
ভূমিকা
প্রিয় পাঠক, টমেটো পৃথিবীর একমাত্র উদ্ভিদজাত পণ্য, যার নামকরণ নিয়ে মার্কিন আদালতে মামলা হয়েছিল ১৮৯৩ সালে। মার্কিন ট্যারিফ আইন ফলের উপরে শুল্ক আরোপ করে না, কিন্তু সবজির উপরে শুল্ক আরোপ করে। ফলে টমেটো ফল নাকি সবজি তাই নিয়ে বিতর্ক হলে মামলাটির সূত্রপাত হয়। এই মামলায় রায় হয় যে টমেটো একটি সবজি ।
আরো পড়ুন: নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করা জরুরী কেনো
আমাদের দেশের টমেটো ফল এবং সবজি দুই হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। এখানে কোন শুল্ক আরোপের বিষয় নাই, তাই টমেটোকে আমরা সহজেই সবজি হিসেবে ধরে নিতে পারি। ফল বা সবজি আমরা যে নামেই টমেটোকে ডাকি না কেন, তার খাওয়ার উপকারিতা এবং অপকারিতার মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। আমরা এটাকে যেমন সবজি হিসেবে খেয়ে থাকি, তেমনি সালাদ হিসাবেও ব্যাপক ব্যবহার আছে।
তাছাড়া শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ইহা ব্যাপক ব্যবহৃত হয়। শিল্প প্রতিষ্ঠানে জ্যাম, জেলি, আচার, চাটনি ইত্যাদি তৈরি হয়।
আসুন টমেটোর ইতিহাস সম্পর্কে জানি
টমেটোর উৎপত্তি মধ্য আমেরিকা থেকে পশ্চিম দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলের মধ্যে। মেক্সিকোর আদিবাসীদের দ্বারা এটা গৃহপালিতকরণ এবং চাষবাসকরণ হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়। অ্যাজটেকরা যখন স্পেন বিজয় করেছিল তখন তারা প্রথম রান্নায় টমেটো ব্যবহার করত। সেই সময়ে স্পেনীয় লোকজন ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় টমেটো নিয়ে আসে।
তখন থেকে ব্যাপক আবাদের সূত্রপাত হয়। এখান থেকে ১৬০০ শতকে ইউরোপিয়ান উপনিবেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বা দেশে টমেটোর ব্যাপক সম্প্রসারণ হয়। সেই সময় এটা পর্তুগিজ নাবিকদের মাধ্যমে ভারতবর্ষে আসে এবং ভারতবর্ষের জলবায়ুর সঙ্গে টমেটো ভালোমতো খাপ খাইয়ে নেয়। ১৮০০ শতকে ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের জন্য এটাকে চাষাবাদ করা হয়।
ফলে টমেটোকে বিলেতি বেগুন নামেও ডাকা হয়ে থাকে। আবার আমাদের দেশে বিশেষ করে দিনাজপুর অঞ্চলে এটাকে টকবেগুন বলে ডাকা হয়।
টমেটোর উদ্ভিদ তত্ত্ব
টমেটো একটি দ্বিবীজপত্রী, বর্ষজীবী, লতা জাতীয় উদ্ভিদ। চাষ আবাদের ভিন্নতার কারণে লম্বায় ৪ থেকে ৬ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। টমেটোকে সবজি হিসেবে বিবেচনা করা হলেও এর পাকা ফলকে রসালো বা বেরি ফল শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়। পরিপক্ক ফলের বীজ থেকে এর বংশ বিস্তার হয়ে থাকে। উৎপত্তিগতভাবে টমেটো একটি শীতকালীন ফসল।
কিন্তু গবেষণা করে এর বিভিন্ন ধরনের জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। বর্তমানে টমেটো ১২ মাস উৎপাদিত হয়, তবে প্রধান দুইটি জাত হল শীতকালীন জাত এবং গ্রীষ্মকালীন জাত। টমেটোর বৈজ্ঞানিক নাম নিয়ে অনেক বিতর্ক ছিল। ১৭৫৩ সালে কেরোলাস লিনিয়াস Solanum গনে স্থাপন করেন। তিনি তখন টমেটোর বৈজ্ঞানিক নাম দেন Solanum lycopersicum।
ফিলিপ মিলার নামে একজন বিজ্ঞানী ১৭৬৮ সালে এটিকে নামকরণ করেন Lycopersicon esculentum . কার্স্টেন ১৮৮৮ সালে Lycopersicum lycopersicum নামকরণ করেন। কিন্তু নানা বিতর্কের কারণে এটি ব্যবহৃত হয়নি। নিকোলসন ১৯৭৪ সালে নামকরণ করেন Lycopersicon lycopersicum । পরবর্তী সময়ে ১৯৮৩ সালে এটার চূড়ান্ত নামকরণ করা হয় Lycopersicum esculentum।
সুতরাং বলা যায় যে টমেটো একটি অতি আলোচিত সবজি, যাহা ফল না সবজি তা নিয়ে যেমন আদালতে মামলা হয়েছিল, তেমনি তার বৈজ্ঞানিক নামকরণ নিয়ে ব্যাপক তর্ক-বিতর্ক, যুক্তি উপস্থাপিত হয়।
বাংলাদেশে টমেটোর উৎপাদন পদ্ধতি
আমাদের দেশে শীতকালে টমেটো বেশি পরিমাণে আবাদ করা হয়। তবে জাত ভেদে বর্তমানে গ্রীষ্মকাল এবং বারোমাস টমেটোর উৎপাদন হয়। আমাদের দেশে BARI (Bangladesh Agriculture Research Institute) এবং BINA (Bangladesh Institute of Neuclear Agriculture) গবেষণা করে বেশ কিছু টমেটোর জাত উদ্ভাবন করেছেন।
এই জাত গুলি আগাম-জাত নামে পরিচিত। আগাম জাতগুলি সাধারণত শীতকালেই উৎপাদিত হয়। আগাম জাতগুলি হচ্ছে বারি টমেটো-৪, বারি টমেটো-৫, টিপু সুলতান, ডেলটা এফ-১, রোমারিও, নিউ রূপালী এফ-১ ইত্যাদি। সারা বছর চাষের জন্য বারি টমেটো-৬ সবচেয়ে বেশি উপযোগী। এছাড়া বিদেশ থেকে আমাদের দেশে অন্যান্য সকল ফসলের মতো টমেটো বীজ আমদানি করা হয়।
শীতকালীন জাতের মধ্যে আছে বারি (BARI) টমেটো-৩, বারি (BARI) টমেটো-৬, বারি (BARI) টমেটো ৭-, বারি(BARI) টমেটো-৯, মানিক, রতন ইত্যাদি। নাবি জাতের ভিতরে আছে বাহার রাজা সুরক্ষা ইত্যাদি এগুলো সাধারণত মার্চ এপ্রিলে ফল পাওয়া যায়। গ্রীষ্মকালীন জাতের ভিতরে আছে লাল বাহাদুর এবং বারি (BARI) টমেটো-৪ এবং বারি (BARI) টমেটো-৮।
আরো পড়ুন: কলার উৎপাদন এবং কলা খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা
বিদেশ থেকে আমদানিকৃত বীজের বর্ণনা বা জাতের নাম সুনির্দিষ্ট ভাবে লেখা থাকে না্ । এমনকি বেশ কিছু ক্ষেত্রে কোড নাম ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে বীজগুলি উচ্চ ফলনশীল জাত এবং অনেক ক্ষেত্রেই রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধী। ফলে দেশি জাতগুলির চাইতে বিদেশী জাতগুলি বেশি পরিমাণ আবাদ করা হয়ে থাকে।
চেরি টমেটো নামে আরেকটি উচ্চ ফলনশীল জাতের টমেটো আমাদের দেশে আবাদ হয়ে থাকে। এর বীজ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। আমাদের দেশে উদ্ভাবিত চেরি টমেটোর নাম বিনা টমেটো-১০।চেরি টমেটোর প্রায় দশটির মতো জাত আমাদের দেশে আবাদ হয়। এগুলি আগাম ফসল হিসেবে আসে। আর এগুলোর বাজার মূল্য অতি উচ্চ।
টমেটো চাষ করতে গেলে প্রথমে বীজতলায় চারা উৎপাদন করতে হয়। চারার বয়স ৩৫ থেকে ৪০ দিন হলে মূল জমিতে রোপন করা হয়। বীজ শোধন করার কোন প্রয়োজন পরে না। কারণ বীজের ব্যবসা যথেষ্ট বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে। প্রত্যেকটা কোম্পানি তার বীজ শোধন করে বপনের উপযুক্ত করে মোরকজাত করে বিক্রয় করে।
বীজতলায় বীজ বোনার পূর্বে ১২ থেকে ২৪ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখলে অঙ্কুরোদগম তাড়াতাড়ি হয়। গ্রীষ্মকালে বীজতলা ১৫ থেকে ২০ সেন্টিমিটার উচ্চতায তৈরি করতে হয়। ২৫ ফুট X ৪ ফুট সাইজের বীজতলা তৈরি করলে চারার যত্ন করতে সুবিধা হয়। টমেটো উৎপাদনের ঋতু এবং টমেটোর জাত ভেদে রোপন দূরত্ব, সারের মাত্রা ইত্যাদিতে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়।
ইউরিয়ার ২-২.৫ কেজি, টি,এস, পি, ১.৫-২.০কেজি, এমওপি ১.০-১.২৫কেজি, গোবর ৩০-৪০কেজি মাত্রায় প্রতি শতকে প্রয়োগ করতে হবে। শেষ চাষের সময় সম্পূর্ণ টিএসপি এবং অর্ধেক গোবর সার ছিটিয়ে দিতে হবে। অর্ধেক গোবর চারা লাগানোর সময় গর্তে দিতে হবে ইউরিয়া এবং এমওপি চারা লাগানোর তৃতীয় ও পঞ্চম সপ্তাহে রিং করে দিতে হবে।
জমির অবস্থা বুঝে যদি মাইক্রো-নিউট্রিয়েন্ট এর প্রয়োজন পরে তাহলে সেগুলো সরবরাহ করা যেতে পারে। জিংক সালফেট, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট, বরিক এসিড, জিপসাম ইত্যাদি মাইক্রো-নিউট্রিয়েন্ট হিসেবে টমেটোর জমিতে প্রয়োজন হতে পারে। এখানে একটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হল গোবরসার অবশ্যই খুব ভালোভাবে পচা হতে হবে এবং শুকনা গুড়া হতে হবে।
মূল জমিতে টমেটোর চারা দুই সারিতে রোপন করতে হয়- সারি থেকে সারির দূরত্ব ৫০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৩৫ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার হওয়া ভালো। জাত এবং চাষাবাদের মৌসুম ভেদে প্রতি শতকে ৭০ থেকে ১০০ কেজি পর্যন্ত টমেটোর ফলন হয়।
টমেটো খাওয়ার উপকারিতা জানুন
টমেটোর ভিতর পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টি উপাদান রয়েছে, যেগুলি আমাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে, রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে এবং আমাদের কর্ম ক্ষমতা বাড়ায়। আসুন টমেটো খাওয়ার উপকারিতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি-
- টমেটোতে আছে ভিটামিন, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, লাইকোপেন, ফাইবার কপার ফলিক অ্যাসিড ইত্যাদি।
- এতে ফলিক এসিড বা ফলের থাকার কারণে রক্ত অল্পতা দূর করে তাই যাদের রক্তস্বল্পতা রয়েছে তাদের প্রতিদিন দুই একটি করে টমেটো খাওয়া দরকার
- সর্দি কাশি বা ঠান্ডার রোগ হলে টমেটো একটু চিনি দিয়ে ভালো করে জাল করে খেলে সর্দি-কাশি দূর হয়
- টমেটোতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি আছে। যাদের দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত পড়া বা পাইরিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব আছে তারা প্রতিদিন টমেটো খেলে মাড়ি থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হয়।
- এটাতে বিদ্যমান ক্যালসিয়াম হাড়ের ক্ষয় রোধ করে এবং হারকে মজবুত করে।
- টমেটোতে পর্যাপ্ত পরিমাণে লাইকোপেন আছে। লাইকোপেন একটি ক্যান্সার প্রতিরোধী উপাদান। বর্তমান সময়ে প্রোস্টেড ক্যান্সারের রোগীর সংখ্যা দিন দিন আশঙ্কাজনক ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। লাইকোপেন প্রোস্টেড ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। তাই যারা পঞ্চাশোর্ধ পুরুষ, তাদের প্রত্যেকদিন টমেটো খাওয়া উচিত।
- মানবদেহে তৈরি হওয়া ফ্রি-রেডিক্যাল ক্যান্সার রোগ তৈরি করে। টমেটোতে বিদ্যমান লাইকোপেন এন্টি-অক্সিডেন্ট হিসাবে কাজ করে যাহা ফ্রি-রেডিক্যাল কে ধ্বংস করে। ফলে ক্যান্সার থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
- বিশেষ করে পাকা টমেটো খাওয়া উচিত। পাকা টমেটো কুচি কুচি করে কেটে রান্নার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খেলে লাইকোপেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
- ইহাতে ভিটামিন এ থাকার কারণে রাতকানা রোগ থেকে রক্ষা করে
- টমেটো খেলে যেমন ত্বকের উপকার হয়, তেমনি বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় তাকে মাখলেও ত্বক অত্যন্ত মসৃণ হয় এবং ত্বককে বলিরেখা থেকে রক্ষা করে
রূপচর্চায় টমেটোর ব্যবহার
- টমেটোতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ ও সি থাকে।পাকা টমেটোর রস এক চামচের সঙ্গে এক চামচ লেবুর রস মিশিয়ে মুখে ব্যবহার করুন। ১৫-২০ মিনিট পরে পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন ইহাতে দ্রুত ব্রণ শুকিয়ে যায়
- টমেটোর রস ত্বকে ব্যবহার করলে ইহা সানবার্ন বা রোদ্রজনিত পোড়া থেকে রক্ষা করে
- কাঁচা টমেটো রস এবং শসার রস একত্রে মিশিয়ে মুখে ব্যবহার করলে মুখের তৈলাক্ত ভাব দূর করে।
- ইহা ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে এবং ত্বকে মোলায়েম করে
টমেটো খাওয়ার অপকারিতা জানুন
- টমেটোতে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম এবং অক্সালেট থাকার কারণে কিডনিতে পাথর তৈরীর সম্ভাবনা থাকে
- এতে সোলানিন নামক অ্যালকালয়েড থাকার কারণে, অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে শরীরের গিটে ব্যথা হতে পারে বা ফুলে যেতে পারে
- লাইকোপেনযেমন উপকারী তেমনি আবার অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে ক্ষতির কারণ হতে পারে। রক্তে অতিরিক্ত লাইকোপেন জমা হলে ত্বকের রং বদলে যেতে পারে।
- অতিরিক্ত টমেটো খেলে এসিডিটি এমনকি ডায়রিয়া পর্যন্ত হতে পারে।
- টমেটো কাঁচা হোক আর পাকা হোক এটা খালি পেটে কখনোই খাওয়া উচিত নয়
লেখকের মন্তব্য
উপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, টমেটো যতটা পরিচিত তার চাইতে বেশি আলোচিত। তবে আমাদের দেশে এটা সবজি না ফল- এ ধরনের কোন বিতর্ক নেই। আমাদের দেশের আবহাওয়া টমেটো চাষের জন্য অত্যন্ত উপযুক্ত। এটি পরিপক্ক, অপরিপক্ক এবং রান্না করে অথবা কাঁচা সকল অবস্থায়ই খাওয়া যায়।
দেশের চাহিদার তুলনায় উৎপাদনের পরিমাণ অনেক কম। তাই বাণিজ্যিকভাবে এর চাষাবাদ করার পর্যাপ্ত সুযোগ রয়েছে। এতে যেমন প্রচুর উপকারী গুণ রয়েছে, তেমনি অতিরিক্ত আহারে ক্ষতিরও কারণ হতে পারে।অতএব আমরা প্রতিদিন প্রয়োজনীয় পরিমাণ টমেটো গ্রহণ করে এর উপকারী দিকগুলির সুযোগ গ্রহণ করব।
তাবিনতান ব্লগের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url