লিচুর উৎপাদন এবং খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা

লিচু একটি সরস এবং অত্যন্ত সুস্বাদু ফল। আমাদের দেশের ধনী-গরিব সবাই আমরা লিচু খেয়ে থাকি। তাই এই লিচুর উৎপাদন এবং খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে আমাদের ধারণা থাকা প্রয়োজন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে লিচুর আবাদ হয়। এশিয়া মহাদেশ লিচুর উৎপত্তিস্থল ৷ ইহা সবচেয়ে বেশি পরিমাণে জন্মে ভারত এবং চীনে।
লিচুর উৎপাদন এবং খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা
আমাদের দেশে যে সমস্ত ফল উৎপাদন হয় লিচু তার মধ্যে অন্যতম ৷ তবে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন এখনো অনেক কম ৷ অন্যান্য ফলের মত এটা দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায় না ৷ পাকা লিচু দেখতে যেমন সুন্দর, আকর্ষণীয় তেমনি সুস্বাদুও বটে ৷

ভূমিকা

আমরা জানি যে বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ ৷ এদেশের মাটি জলবায়ু এবং আবহাওয়া প্রায় সকল ফসল চাষের জন্য উপযুক্ত ৷ এখানে যেমন পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্যশস্য, শাক সবজি উৎপাদিত হয়, তেমনি ফলমূলও কোন অংশে কম উৎপাদন হয় না ৷ বাংলাদেশে উৎপাদিত মৌসুমি ফলের মধ্যে আম কাঁঠালের পরই লিচুর অবস্থান রয়েছে ৷ 

এই ফলের চাহিদা যেমন অনেক বেশি বাজার মূল্যও তেমনি অনেক বেশি ৷ তবে সকল জেলাতে উৎপাদিত হয় না ৷ দিনাজপুর আমাদের দেশে লিচু উৎপাদনের একটি পুরাতন জেলা ৷ সেখান থেকে রাজশাহীর চাঁপাই নবাবগঞ্জ হয়ে পাবনার ঈশ্বরদী এখন উল্লেখযোগ্য পরিমান লিচুর আবাদ হয় ৷ আসুন আমরা এই ফলটির সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই -

লিচু একটি বহুবরষী চিরহরিৎ উদ্ভিদ ৷ এই উদ্ভিদের সরস ফল আমরা লিচু হিসাবে খাই ৷ লিচুর উৎপত্তিস্থল হলো দক্ষিণ-পূর্ব চীনের কুয়াতুং এবং ফুজিয়ান প্রদেশ ৷ সেখানে ১১ শতাব্দীতে লিচুর আবাদ শুরু হয় ৷ লিচুর প্রধান উৎপাদনকারী দেশ হচ্ছে চীন ৷ লিচুর দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎপাদনকারী দেশ হচ্ছে ভারত ৷

সেখান থেকে ভিয়েতনামসহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশ, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, মাদাগাস্কার এবং আফ্রিকায় লিচুর আবাদ বিস্তার লাভ করেছে ৷

লিচুর উৎপাদন সম্পর্কে জেনে নেই

বর্তমান সময়ে অর্থাৎ ২০২২ সালে পৃথিবীতে লিচু উৎপাদনের দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ অবস্থান করছে ৷ আর তাইওয়ান আছে তৃতীয় অবস্থানে ৷ সারা বিশ্বের লিচুর প্রায় ২০০ টি জাত আছে ৷ আবহাওয়া ভেদে এগুলো বিভিন্ন ঋতুতে আবাদ করা হয় ৷ চায়নাতে আট দশটি জাতের আবাদ হয় এবং ভারতে প্রায় ১০-১২টি জাতের লিচুর আবাদ হয়ে থাকে ৷
 

একই জাতের লিচু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আবহাওয়া ও জলবায়ু গত কারণে একেক ধরনের আকার আকৃতি এবং যার ফলে একেক ধরনের নাম হতে দেখা যায় ৷বাংলাদেশে কম বেশি প্রায় সকল জেলায় লিচুর আবাদ হয় ৷ তবে দিনাজপুর জেলাকে বাংলাদেশের লিচু আবাদের সবচেয়ে পুরাতন স্থান হিসেবে ধরা হয় ৷ তারপর মেহেরপুরের স্থান। 

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে লিচু আবাদ হয় দিনাজপুর, ঈশ্বরদী, নাটোর, রাজশাহী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ ৷ এছাড়া কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, যশোহর, মানিকগঞ্জ এবং চট্টগ্রামেও উল্লেখযোগ্য পরিমান লিচুর আবাদ হয়৷

২০২৩ সালে পাবনা জেলায় ৪ হাজার ৭১১ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে ৷ এরমধ্যে শুধুমাত্র ঈশ্বরদীতে তিন হাজার একশ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে ৷ আবাদকৃত এই সমস্ত জমিতে যেসব জাতের লিচু আবাদ হয় সেগুলো হচ্ছে সেগুলো হচ্ছে- স্থানীয় জাত বা মোজাফফর, বোম্বাই এবং চায়না থ্রি ৷ তবে পরিমাণের দিক থেকে বোম্বাই জাতটি বেশি আবাদ হয়ে থাকে ৷ 

অনেকেই দিনাজপুর থেকে বেদানা জাতের চারা এনে বেশ সফলকাম হয়েছেন ৷ বর্তমানে বাংলাদেশে আবাদকৃত লিচুর জাতের মধ্যে বেদানাই সর্বোৎকৃষ্ট ৷ তাছাড়া এখানে চায়না এক, চায়না দুই এবং কাঁঠালি জাতের লিচুর আবাদ হয় ৷ ঈশ্বরদীতে লিচু আবাদের ইতিহাস দিনাজপুরের মত এত পুরাতন নয় ৷ মোটামুটি ৩০-৩৫ বছর পূর্বে এখানেলিচু আবাদের গোড়া পত্তন শুরু হয় ৷ 

তখন মানুষ শখ করে বাড়ির আশেপাশে দু-চারটে লিচু গাছ লাগাতেন ৷ এখানে লিচুর উৎপাদন এত প্রসার লাভ করেছে যার কারণে তিনি হলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের দক্ষ শিক্ষক, প্রফেসর ড. মোঃ আব্দুর রহিম ৷ তিনি ঈশ্বরদীতে লিচু আবাদ উৎসাহিত করেন ৷

লিচু গাছ লাগানোর নিয়ম জেনে নেই

প্রিয় পাঠক, লিচুর বীজ থেকে চারা তৈরি করা হয় না। কারণ এক্ষেত্রে মাতৃগাছের গুনাগুন বজায় থাকে না। তাই কলমের মাধ্যমে লিচুর চারা উৎপাদন করা হয়। এই উৎপাদিত চারা জমিতে লাগানো হয়। জমিতে লাগানোর পূর্বে একটি গর্ত করা হয়। গর্তে প্রয়োজনীয় পরিমাণ জৈব সার এবং রাসায়নিক সার এবং মাটি দিয়ে  ভরাট করা হয়।

রাসায়নিক সারের পরিমাণ নির্ভর করে সেই জমির উর্বরতার অবস্থার উপর এবং কলমের/ চারার আকার আকৃতি ও বয়সের উপর। সাধারণত গর্ত প্রতি ৫০০ গ্রাম টিএসপি, ৪০০ গ্রাম এমওপি, ৩০০ গ্রাম জিপসাম, ৫০ গ্রাম জিংক সালফেট এবং ১৫/২০ কেজি জৈব সার ও পরিমাণ মতো মাটি দিয়ে গর্ত ভরাট করতে হয়। গর্তের ভিতর ইউরিয়া সার না দেওয়াই উত্তম। 

চারা লাগানোর পর নিয়মিত পানি দিতে হয় এরপরে দুই থেকে তিন মাস পরে অবস্থা বুঝে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। ফুল আসা শুরু হলে প্রথম ২-৩ বছর লিচুর ফুল ভেঙে দিতে হয়। এতে করে পরবর্তীতে ফলনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। ফল ধরার পরে প্রত্যেক বছর অপ্রয়োজনীয় ছোটখাটো ডালপালা বা শাখা-প্রশাখা ছেটে দিতে হয়।

আসুন লিচুর জাতসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত জানি

২০২৩ সালে দিনাজপুরে ৪৪৮০ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ করা হয় ৷ এখানে আবাদকৃত লিচুর জাতগুলি হল বেদানা, চায়না থ্রি, মাদ্রাজি এবং বোম্বাই ৷ বেদানা জাতের লিচু সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের, আকারে বড় এবং দামও বেশি ৷ এরপরে আসে চায়না-৩ জাতের লিচু ৷ তবে জাত ভিত্তিক উৎপাদনের পরিমাণে বেদানা ৫%, চায়না-৩ ২৫% এবং মাদ্রাজি ও বোম্বাই ৭০ % ৷

২০২৩ সালে দিনাজপুর থেকে ফ্রান্সে প্রথমবারের মতো লিচুর রপ্তানি করা হয় ৷ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট গবেষণার মাধ্যমে চারটি লিচুর জাত উদ্ভাবন করেছেন ৷ জাতগুলির নাম বারি লিচু-১, বারি লিচু-২, বারি লিচু-৩, বারি লিচু-৪ ৷ এদের মধ্যে বাড়ি লিচু-৪ সবচেয়ে উত্তম জাত ৷ তবে এই জাতটি আবাদ করতে নিয়মিত সেচের প্রয়োজন হয় ৷ 

সেচ ছাড়া আবাদ করলে ফলন প্রায় শূন্যের কোঠায় ৷ হেক্টর প্রতিফলন প্রায় ১০ টন ৷

লিচুর পুষ্টিগুণ এবং লিচু খাওয়ার উপকারিতা

লিচু আবাদ করে একদিকে যেমন অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যাচ্ছে, অপরদিকে তেমনি লিচু খেয়ে আমাদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করছে ৷ কারণ লিচু একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর ফল ৷ লিচুতে রয়েছে বিভিন্ন প্রকারের ভিটামিন এবং ভিটামিন সি ৷ মিনারেল এবং এন্টিঅক্সিডেন্টও রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ৷ লিচুর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৫০ অর্থাৎ কম হয় ডায়াবেটিস রোগীরাও এটা খেতে পারবেন। 

তবে ডায়াবেটিস রোগীদের মাত্রার অতিরিক্ত লিচু খাওয়া যাবে না। পরিমিত পরিমাণে লিচু ডায়াবেটিস রোগীরাও খেতে পারবে ৷ লিচুতে প্রচুর পরিমাণে পানি থাকায় এই ফলটি ডিহাইড্রেশনের জন্য যথেষ্ট উপকারী ৷

লিচু খাওয়ার অপকারিতা জানুন

লিচু অত্যন্ত পুষ্টিকর ও সুস্বাদু হওয়ার পরেও এর অনেক ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে ৷ লিচুতে বিশেষ করে লিচুর বীজে বেশ কিছু রাসায়নিক দ্রব্য আছে যা মানুষের জন্য ক্ষতিকর ৷ এমনকি শিশুরা লিচুর বিচি খেয়ে ফেললে মৃত্যুর মতো ঘটনার প্রমাণ রয়েছে ৷ তাই বাচ্চাদেরকে লিচু খাওয়ানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে যে তারা যেন বেশি খেয়ে না ফেলে ৷ 

লিচুর উৎপাদন এবং খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা
অনেক সময় লিচুর শ্বাসের ভিতর এই উপাদান কম বেশি থাকে যাহা বাচ্চারা যদি খালি পেটে খায় তাহলে তার বিষক্রিয়া শুরু হয় ৷ ডায়াবেটিস রোগীরা লিচু খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। নিয়মিত রক্তের সুগার পরীক্ষা করা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য প্রয়োজন।

লিচুর বাজারমূল‌্য

লিচুর বাজারমূল‌্য সব বছর সমান থাকে না। তবে ২০২৩ সালের চাইতে ২০২৪ সালে গড়ে ১০০-১৫০ টাকা বেশী ছিল প্রতি ১০০ লিচুর দাম। 

লেখক এর মতামত

প্রিয় পাঠক বৃন্দ, এতক্ষণে আমরা নিশ্চয়ই লিচু সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম ৷ চাহিদার তুলনায় এই ফলটির উৎপাদনের পরিমাণ অনেক কম। আর আমাদের দেশে তো লিচু আবাদের আবহাওয়া এবং জলবায়ু খুবই উপযোগী। তাই এখানে একটি বড় ধরনের ব্যবসায়িক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। লিচুর আবাদ যেমন সহজ তেমনি লাভজনক ৷

লিচু খাওয়া যেমন পুষ্টিকর, সুস্বাদু এবং উপকারী তেমনি এটার ভিতরে অনেক ধরনের ঝুঁকি রয়েছে ৷ তবে একটু সতর্কতা অবলম্বন করলেই এই ঝুঁকিকে এড়ানো যায় ৷


তথ্যসূত্র: লেখক একজন কৃষিবিদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

তাবিনতান ব্লগের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url