সড়ক দুর্ঘটনা এবং তার কারণ ও প্রতিরোধ
ভূমিকা
প্রায় ১৭ কোটি জনগণের দেশ এই বাংলাদেশ। এখানে কোন একটি কাজ করতে গেলে এত সংখ্যক জনগণকে মোকাবেলা করতে হয়, বা এত সংখ্যক মানুষকে মোকাবেলা করে কাজটি করতে হয় যে, তাতে সকল কাজে সকল জায়গায় যানজট তৈরি হয়। এই যানজটকে অতিক্রম করতে প্রচুর সময় ব্যয় হয়, এমনকি এক সময় মল্লযুদ্ধ করতে হয়।
এই প্রতিবন্ধকতাটি যদি তৈরি হয় সড়কপথে, তাহলেই একটি দুর্ঘটনার সৃষ্টি করে। আমাদের দেশে সড়কপথে চলার বেশ কিছু আইন থাকলেও অধিক সংখ্যক জনগণ এবং কম পরিমাণে রাস্তাঘাট হওয়ার কারণে সেই আইনের তোয়াক্কা কেউ করে না। সড়কপথে চলমান প্রচুর ধরনের যানবাহন রয়েছে। এর মধ্যে দুই চাকা, তিন চাকা, চার চাকার গাড়ি।
আরও পড়ুন: নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করা জরুরী কেনো
শুধু তাই নয়, ১২ চাকার ট্রাক পর্যন্ত আমাদের রাস্তায় চলে। প্রত্যেকটি যানবাহনের একটি করে নিজস্ব গতিসীমা আছে। সবাই দ্রুত আগে যাওয়ার জন্য এই গতিসীমার সম্পূর্ণটাই ব্যবহার করে রাস্তায় চলাফেরা করে। ফলে পরস্পরের সংঘর্ষ বা ধাক্কাধাক্কি লেগে যায়। এই ধাক্কাধাক্কি লাগাটাই হলো সড়ক দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ।
আবার এই সমস্ত যানবাহনের সঙ্গে রয়েছে পথচারী। পথচারীরা রাস্তা পারাপার হওয়ার সময় যানবাহনের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে দুর্ঘটনা তৈরি করতে পারে। এই সকাল সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। যেমন যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, চালক বা যাত্রীর হাত পা কাটাছেড়া, ভাঙ্গা, বিকলাঙ্গ হয়ে দীর্ঘকাল বিছানায় জীবন কাটানো, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে থাকে।
সড়ক দুর্ঘটনার কারণসমূহ কি?
- অসচেতন ভাবে পথচারীদের রাস্তা পারাপার হওয়া এবং রাস্তায় চলাফেরা করা
- অনানুমোদিত যানবাহন হাইওয়েতে চলাফেরা করা- সাধারণত তিন চাকার ইঞ্জিনওয়ালা গাড়িগুলি হাইওয়েতে চলাফেরা করা বর্তমান সময়ে নিষিদ্ধ। তারপরও সিএনজি সহ অন্যান্য তিন চাকার গাড়িগুলি হাইওয়েতে চলাফেরা করে এবং দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়।
- ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো- যে সমস্ত গাড়ি অনেক পুরাতন হয়ে গেছে, বা তার স্পেয়ার পার্টস গুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই সমস্ত গাড়িগুলি পাবলিক প্লেসে না চালানোর জন্য আমাদের দেশে আইন থাকলেও এই গাড়িগুলি সড়কপথে চলমান রয়েছে ।এগুলি দুর্ঘটনার একটি কারণ।
- লাইসেন্সবিহীন এবং অদক্ষ চালক- জীবন ও জীবিকার তাগিদে মানুষ আইনকে অমান্য করে বিভিন্ন ধরনের গাড়ি চালানোর পেশায় নিয়োজিত হয়ে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় দুর্ঘটনার মূলে রয়েছে লাইসেন্সবিহীন এবং অদক্ষ চালক। সকল ধরনের যানবাহন চালানোর জন্য আমাদের দেশে বিআরটিএ কর্তৃক একজন চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া হয়।
- এই সমস্ত বৈধ লাইসেন্স ধারী চালকের সঙ্গে কিছু অসাধু লোকজন দালালের মাধ্যমে নকল লাইসেন্স সংগ্রহ করে রাস্তায় গাড়ি চালায়। তবে বর্তমানে ডিজিটাল পদ্ধতি আসার কারণে অনেকাংশেই তা দূর হয়েছে। লাইসেন্স পেলেও একজন চালক দক্ষ হয়ে যায় তাও ঠিক না। আসলে দীর্ঘদিন গাড়ি চালানোর কারণে একজন চালক দক্ষ হয়ে ওঠে।
- অনঅনুমোদিত ব্যক্তির দ্বারা গাড়ি চালানো- অনেক সময় দেখা যায় ট্রাকের ড্রাইভার যখন একটু বিশ্রাম নেয়, তখন তার হেল্পার গাড়িটা স্টার্ট করে রাস্তায় ওঠে। এই সময়ই দুর্ঘটনা ঘটে।
- দ্রুত যাওয়ার চেষ্টা- রাস্তায় চলার সময় সবাই সবাইকে অতিক্রম করে আগে যাওয়ার চেষ্টা করে। ফলে একাধিক গাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটে। গাড়ির দ্রুতগতি এবং একজন আরেকজনকে অতিক্রম করার চেষ্টায় প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ দূর্ঘটনা ঘটে। আমাদের দেশে সকল প্রকার যানবাহনই এই ধরনের কান্ডটি ঘটিয়ে থাকে।
- সংক্ষিপ্ত রাস্তায় বেশি গতিবেগ- গন্তব্যস্থলের খুব কাছাকাছিতে গিয়ে বা ৫০-১০০ গজ দূর থেকেও মানুষ তার সামনের গাড়িকে ওভারটেকের চেষ্টা করে। এটা অত্যন্ত বোকামি যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটায়। সে মনে করে যে, আমি তো আমার গন্তব্যে এসে গেছি এখন দ্রুত গিয়ে পৌঁছে যাব। ফলে তার ভিতরে এক ধরনের অসুস্থ মানসিকতার তৈরি হয় যা দুর্ঘটনা ঘটায়।
- অপ্রস্তুত অবস্থায় গাড়ি চালানো- সকল প্রকার যানবাহনই রাস্তায় চালানোর জন্য চালকের একটি প্রস্তুতিমূলক অবস্থা থাকতে হয়। যে কোন প্রকার শারীরিক অসুস্থতায় যানবাহন না চালানো উত্তম। তাছাড়া এমন অনেক প্রকার ওষুধ রয়েছে যাহা ঘুমের ভাব তৈরি করে বা সিডেটিভ ইফেক্ট সম্পন্ন। এই সমস্ত ওষুধ সেবন করে যানবাহন চালানোর ফলে দুর্ঘটনার শিকার হতে হচ্ছে।
- বর্তমান সময়ে নেশার ছোবল জাতিকে আষ্টে-পৃষ্ঠে আটকে রেখেছে। মাদকাসক্ত চালকেরা গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে।
- মহাসড়কে অনুমোদিত গাড়ি চালানো- আমাদের দেশে মহাসড়কে তিন চাকার গাড়ি যেমন রিকশা, অটোরিকশা, সিএনজি ইত্যাদি চালানো নিষেধ থাকলেও তাহা চালানো হয়, ফলে দুর্ঘটনা ঘটে
- অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বোঝাই- এটি গাড়িতে যখন মাথা অতিরিক্ত যাত্রী এবং মালামাল বোঝাই করা হয়, তখন অনেক সময় চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হয়
- আইনের প্রয়োগের দুর্বলতা অথবা দুর্বল আইন- শক্ত আইন তৈরি করতে হবে এবং আইনের শক্ত প্রয়োগ করতে হবে। একটি দুর্ঘটনা ঘটার ফলে যে শাস্তির বিধান রয়েছে তা যথেষ্ট নয়, অথবা প্রয়োগে দুর্বলতা রয়েছে, ফলে পরবর্তী সময়ে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে
- অন্যান্য কারণসমূহ- আঁকাবাঁকা রাস্তা, রাস্তায় সঠিকভাবে সাইন বোর্ড না থাকা ইত্যাদি
- মোটরসাইকেল বর্তমানে আমাদের দেশের দুর্ঘটনা প্রবণ একটি যানবাহনে পরিণত হয়েছে। এখানে অধিকাংশ চালকেরই ড্রাইভিং লাইসেন্স নাই বা একটি বাড়িতে একটি মোটরসাইকেল থাকলে একজনের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে। বাদবাকি সদস্যরা লাইসেন্স ছাড়াই মোটরসাইকেল ব্যবহার করে।
- তাছাড়া ১৮ বছরের কম বয়সী ছেলেরাও আইন অমান্য করে মোটরসাইকেল চালাচ্ছে। এবং তারাই মূলত অতি দ্রুত গতিতে রাস্তায় মোটরসাইকেল চালানোর কারণে দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে। তারা প্রতিযোগিতামূলকভাবে রাস্তায় চলাফেরা করে।
- প্রতিযোগীতা বা জেদ ধরে অনেক সময় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটায়।
- শীতকালে ব্যাপক কুয়াশা পরে। বিশেষ করে আমাদের দেশের উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলাতে কুয়াশার কারণে দিনের বেলাতেও গাড়ি চলাচল অনেক সময় বিঘ্নিত হয়। এই সময় এই গাড়ির হেডলাইট না জ্বালিয়ে গাড়ি চালানোর কারণে গাড়ি দুর্ঘটনায় পতিত হয়।
- গাড়ি চালানো অবস্থায়, এমনকি অনেক সময় দেখা যায় অনেক মোটরসাইকেল চালক মোটরসাইকেল চালানো অবস্থায় মোবাইল ফোন ব্যবহার করে, এটা দুর্ঘটনার একটা বড় কারণ।
- অপ্রসস্ত রাস্তায় অধিক সংখ্যক গাড়ি-ঘোড়া চলাফেরা করা
- প্রয়োজনীয় সংখ্যক ট্রাফিক পুলিশের উপস্থিতি না থাকা
- ভাঙ্গাচুরা রাস্তাঘাট উঁচু নিচু রাস্তাঘাট ইত্যাদি
- ঈদ, পূজা ইত্যাদি সময়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ যাতায়াত করে থাক। এই সময়ে অতিরিক্ত যানবাহন রাস্তায় যাত্রী বোঝাই অবস্থায় চলাফেরা করে। একটি গাড়ি এই সময় একাধিকবার ট্রিপ দেওয়ার চেষ্টা করে। ফলে দ্রুততার সাথে গাড়ি চালানোয় দুর্ঘটনায় শিকার হয়
সড়ক দুর্ঘটনার প্রভাব বা ফলাফল কি?
- সড়ক দুর্ঘটনার ফলে যানবাহন ভাঙচুর এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- যানবাহনে বিদ্যবান মালামাল গাড়ির চালক এবং যদি যাত্রী থাকে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- আশেপাশে থাকা দোকান বাড়িঘর এবং মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- প্রতিবছর আমাদের দেশে যানবাহন দুর্ঘটনার ফলে বা সড়ক দুর্ঘটনার ফলে প্রচুর সংখ্যক লোক মারা যায়। এর প্রায় দুই থেকে তিনগুণ লোক পঙ্গুত্ব বর্জন বরণ করে। ফলে সেই পরিবারগুলো অসহায় হয়ে পরে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটি পরিবারের রোজগারের মানুষ একজন থাকে। সেই ক্ষেত্রে সেই পরিবার রাস্তায় বসে যায়।
কিভাবে সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিরোধ করা যায়?
সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করতে আমাদেরকে ব্যক্তি পর্যায়ে, সরকারি পর্যায়ে এবং সামাজিকভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। নিচে সড়ক দুর্ঘটনার কারন প্রতিরোধ কল্পে যে সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন তাহা আলোচনা করা হলো-- সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের জন্য ব্যাপকভাবে জনসচেতনতা তৈরি করা দরকার। আমাদের মনে রাখতে হবে যে সময়ের চাইতে জীবনের দাম অনেক বেশি
- পথচারীদেরকে সতর্কভাবে রাস্তা পারাপার করতে হবে
- ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলি নিয়ে রাস্তাতে চলাফেরা না করা
- প্রতিদিন সকালে গাড়ি রাস্তায় বের করার পূর্বে গাড়ির ব্রেক, হর্ন এবং অন্যান্য জরুরি যন্ত্রাংশ ভালোভাবে চেক করে নিতে হবে
- ওভারলোড ভাবে গাড়ি না চালানো
- দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকারি বিভিন্ন আইন এবং কার্যক্রমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে
- গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে
- গাড়ি চালককে সিট বেল বাঁধতে হবে, মোটরসাইকেল চালককে হেলমেট ব্যবহার করতে হবে
- গাড়ি চালানো অবস্থায় কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাতে হবে
- লুকিং গ্লাস ব্যবহার করতে হবে, বিশেষ করে ওভারটেকের সময় এবং টার্নিং পয়েন্টে
- ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হবে
- রাস্তার বিভিন্ন বাঁকে বা তিনমাথা বা চারমাথার মোড়ে গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং রাস্তার পাশে যে সমস্ত সাইনবোর্ড থাকে সেগুলি ফলো করতে হবে
- ব্লাইন্ড কর্নার গুলিতে দেখে শুনে হর্ন দিয়ে সাইট দিয়ে সাইট নিতে হবে
- অসুস্থ বা নেশাগ্রস্থ অবস্থায় গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকতে হবে
- বিআরটিএ কর্তৃক চালককে লাইসেন্স দেওয়ার পূর্বে চালকের দক্ষতা ভালোভাবে যাচাই করতে হবে। এবং এইসব ক্ষেত্রে কোন ধরনের অসৎ পন্থার অবলম্বন করা যাবে না
- মহাসড়কের সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে হবে
- কুয়াশাচ্ছন্ন সময়ে গাড়িতে ফগ লাইট ব্যবহার করতে হবে
- ঈদ পূজায় ইত্যাদি বিভিন্ন পার্বণের সময় যখন অধিক সংখ্যক মানুষ রাস্তায় চলাফেরা করে। তখন ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো দরকার। বিভিন্ন আইন প্রকারী সংস্থা আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা অনেক অংশেই রোধ করতে পারে
লেখক এর মন্তব্য
আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হয়। এদের মধ্যে অনেকে শারীরিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়, কেউ পঙ্গুত্ব বরণ করে, আবার অনেকেই মারা যায়। অথচ সামান্য একটু সতর্কতা অবলম্বন করলেই আমরা এই মৃত্যুকে রোধ করতে পারি। মানুষের জীবনের মূল্যবোধ, সামাজিক মূল্যবোধ তৈরি করতে হবে।
সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে এগুলো তৈরি করা সম্ভব। তাছাড়া সরকারি আইন এবং নিয়ম কানুন গুলি সঠিকভাবে মেনে চলতে হবে।আইন প্রয়োগকারি সংস্থার লোক জন এই ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। প্রশিক্ষণ বিহীন চালক আর ফিটনেসবিহীন গাড়ি সমান অপরাধে অপরাধী। রাস্তা পারাপারের সময় পথিককেও দেখে শুনে রাস্তা পাড়ি দিতে হবে।
তাই সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে একই স্লোগানে- ”নিরাপদ সড়ক চাই”।
তাবিনতান ব্লগের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url