মেধা পাচার কি? মেধা পাচারের কারণ ও ফলাফল
দক্ষ জনশক্তি বা কারিগরি জ্ঞান সম্পন্ন লোকজন যেমন- কৃষিবিদ, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, নার্স, যেকোনো ধরনের টেকনিশিয়ান, আইনজীবী, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, লেখক সাংবাদিক ইত্যাদি ব্যক্তিবর্গকে সাধারণত মেধাবী হিসেবে ধরা হয়। এই মেধাবী লোকজন যখন এক দেশ থেকে অন্য দেশে দীর্ঘদিনের জন্য বা স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য চলে যায় তখন তাকে মেধা পাচার বলা হয়।
মেধা পাচার একটি দেশের জন্য অবশ্যই অমঙ্গল বয়ে আনে। মেধা পাচারের কারণে সমাজ,জাতি বা দেশ অন্তসারশূন্য হয়ে পরে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশ থেকে মেধা পাচার হওয়া অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এটি একটি আমাদের দেশের অন্যতম জাতীয় সমস্যা। তাই এটাকে রোধ করা জরুরী।
ভূমিকা
আমাদের দেশ থেকে প্রতিবছর বেশ কিছু সংখ্যক পুরুষ এবং মহিলা দেশান্তরিত হন। এই সকল জনবলের মধ্যে অনেকেই অস্থায়ীভাবে বা কিছুদিনের জন্য বা কিছু সময়ের জন্য গমন করেন। অর্থাৎ তারা একটি নির্দিষ্ট সময় পরে আবার বাংলাদেশে ফিরে আসেন। আর বেশ কিছু সংখ্যক জনসমষ্টি স্থায়ীভাবে বিদেশে বসবাস শুরু করেন।
এই সমস্ত জনসমষ্টি কখনোই দেশে আর ফিরে আসেন না। স্বল্পকালীন সময়ের জন্য মানুষ বিদেশে গমন করে শিক্ষার জন্য, চিকিৎসার জন্য এবং চাকুরীর জন্য। আর স্থায়ীভাবে বসবাস করার অনেকগুলি কারণ রয়েছে। তার মধ্যে শিক্ষা চিকিৎসা এবং চাকুরী তো অবশ্যই আছে। এর বাইরেও অনেকগুলি কারণ আছে যা আমরা নিচে আলোচনা করব।
মেধা পাচার কি? তা সঠিকভাবে বুঝতে না পেরে অনেকেই মেধা পাচারের সাথে মানব পাচারকে গুলিয়ে ফেলেন । মানব পাচার অন্য একটি বিষয়। মানব পাচারের সাথে মেধা পাচারের কোন সম্পর্ক নেই। বড় মানের কিছু অপরাধী চক্র মানব পাচারের কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। তারা নিজেদের স্বার্থে কাজটি সংঘটিত করে। মানব পাচারের বিষয়টি নিয়ে আরেকটি ব্লগে বিস্তারিত আলোচনা করব।
আরো পড়ুন: ফ্রিল্যান্সিং কি ? ফ্রিল্যান্সিং শিখতে কতদিন সময় লাগে?
শিক্ষাবিদ, প্রযুক্তিবিদ, বিজ্ঞানী, দক্ষ জনশক্তি, টেকনিশিয়ান ইত্যাদি ব্যক্তিবর্গ ইচ্ছাকৃতভাবে বা চাপে পড়ে বৈধ কাগজপত্রের মাধ্যমে যখন দেশ থেকে অন্য দেশে গমন করে তখন তাকে মেধা পাচার বলে। এর ফলে একটি দেশ অন্তঃসারশূন্য হয়ে পরার সম্ভাবনা থাকে। ’’ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম’’ বাংলাদেশে ২০২০ সালে একটি জরিপ করে।
এই জরিপে দেখা যায় ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী প্রায় ৮২ শতাংশ যুবক অর্থনৈতিক এবং উন্নত জীবন যাপনের জন্য দেশত্যাগে আগ্রহী। যুব সমাজ একটি রাষ্ট্রের কাঠামো হিসেবে কাজ করে। তারপরও যদি তারা দক্ষ হয় এবং এই দক্ষ যুব সমষ্টি যদি রাষ্ট্র পরিত্যাগ করে তাহলে সে রাষ্ট্রের জন্য এটা হবে অমঙ্গল এবং হুমকি।
মেধা পাচার কি? বা মেধা পাচার কাকে বলে?
প্রিয় পাঠক মেধা পাচার কি? শব্দটা শুনলে মনে হয় যে, মেধা কোন একটি পণ্য যা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গমন করে বা পাচার হয়ে যায়। কিন্তু বিষয়টা সেরকম কোন কিছু না। উচ্চশিক্ষিত বা উচ্চ কর্মদক্ষতা সম্পন্ন ব্যক্তি বা মেধা সম্পন্ন ব্যক্তি যখন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বা এক দেশ থেকে অন্য দেশে স্থায়ীভাবে বা দীর্ঘদিনের জন্য গমন করে তখন সেটাকে আমরা মেধা পাচার বলি।
এই সমস্ত মেধাবী লোকজন বর্তমান স্থানে বিভিন্ন প্রকারের অসুবিধা অথবা নতুন স্থানে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকার কারণে দেশান্তরিত হয়। যার ফলে সংঘটিত হয় মেধা পাচার। মেধা পাচারের ফলে ব্যক্তি তার বর্তমান স্থানের অসুবিধাকে দূর করতে পারে, অথবা সে নতুন স্থানের সুবিধাসমূহ ভোগ করে বা মূল্যায়নসমূহ ভোগ করে।
আরো পড়ুন: সড়ক দুর্ঘটনা এবং তার কারণ ও প্রতিরোধ
কিন্তু এর ফলে সমাজ বা রাষ্ট্র তার একটি রত্ন হারায় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ মেধা পাচারের ফলে একটি সমাজ, দেশ বা রাষ্ট্র তার উচ্চ দক্ষতা ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন এবং শিক্ষিত মানবসম্পদ হারায়। অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে বা উন্নত দেশে সাধারণত মেধা পাচার ঘটে থাকে। তাহলে আমরা মেধা পাচার কি? এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পেলাম।
বাংলাদেশ থেকে মেধা পাচারের কারণ বা মেধা পাচার কেন হয়?
- মানবাধিকার- মানবাধিকার ক্ষুন্ন হওয়ার ফলে আমাদের দেশ থেকে অনেক মেধাবীরা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তারা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছেন।
- দারিদ্রতা বা অর্থনৈতিক সুযোগের অভাব- কর্মসংস্থানের অভাব বা অর্থনৈতিক অভাবের কারণে আমাদের দেশ থেকে বিপুল সংখ্যক লোকজন বিদেশে গিয়ে বসবাস শুরু করে। এইসব ক্ষেত্রে শিক্ষিত, কারিগরি জ্ঞান সম্পন্ন, কম লেখাপড়া জানা এবং অশিক্ষিত ইত্যাদি বিভিন্ন শ্রেণীর লোকজন রয়েছে। তারা তাদের ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর জন্য স্বদেশ ত্যাগ করে।
- সংঘাতের সূত্রপাত - ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন কারণে সংঘাত হয়। এই সকল সংঘাতের ফলে কিছু জনগণ বিদেশে চলে যায় নিরাপত্তার কারণে।
- নিপীড়নরে কারন- বিভিন্ন কারণে দেশের লোকজন নিপীড়িত হন। রাজনৈতিক কারণ তার মধ্যে অন্যতম। অর্থনৈতিক নিপীড়নও অনেকটাই এই সকল ক্ষেত্রে কাজ করে। ফলে যাদের সুযোগ রয়েছে তারা এই সমস্ত নিপীড়ন থেকে বাঁচার জন্য দেশান্তরিত হন।
- অস্থিতিশীল সামাজিক ব্যবস্থা- সামাজিক ব্যবস্থা যখন ত্রুটিপূর্ণ হয় বা পরিস্থিতিশীল হয় তখনই কিছু মেধাবী লোকজন দেশের বাহিরে চলে যায়
- গুণগত শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গমন- শিক্ষা ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ত্র ও অসম্পূর্ণ হওয়ার কারণে আমাদের দেশ থেকে অনেক উচ্চশিক্ষিত মেধাবী জনগণ প্রতিবছর অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকা, ইউরোপ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে লেখাপড়া করার জন্য যায়। তাদের মধ্যে যারা সুযোগ পেয়েছে, তাদের অনেকেই আর দেশে ফিরে আসেনি।
- ভ্রমণপিপাসু- ভ্রমনপিপাসু কিছু মানুষ আছে তারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ায়। ঘুরতে ঘুরতে তাদের যখন কোন একটি দেশ খুব ভালো লেগে যায় তখন তারা সেই দেশে স্থায়ী নিবাস শুরু করে। তবে বাংলাদেশ থেকে দেশান্তরিত হওয়ার বা মেধা পাচারের এই সংখ্যা খুবই নগণ্য।
- দুর্দমনীয় দুর্নীতি- এই বিষয়ে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। চলতি মাসে অর্থাৎ জানুয়ারি ২০২৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র তার স্বর্ণপদক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিকটে ফেরত দেন। বিষয়টি নিয়ে প্রচার মাধ্যমে চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ছাত্রটির অভিযোগ, সে বিশ্ববিদ্যালয় অনার্স এবং মাস্টার্সে ভালো পরীক্ষার ফলাফল করে।
- চাঁদাবাজ ও পেশি শক্তি- নিজে বৈধ ইনকাম করে, ব্যবসা-বাণিজ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি করার সুযোগও আমাদের দেশে অনেকাংশই কম। কারণ প্রতিটি ক্ষেত্রে তো দুর্নীতি এবং ঘুষের প্রচলন আছেই। তার উপরে আবার চাঁদাবাজ এবং পেশি শক্তির প্রয়োগ ব্যাপকভাবে কাজ করে। ফলে মেধাবীদের পক্ষে এখানে উদ্যোক্তা হয়ে কিছু করাটাও ব্যাপক ঝুঁকিপূর্ণ।
কিছু সংখ্যক মেধাবী লোক তার মেধাকে এই দেশে ব্যবহার না করে মনের রাগে দেশ থেকে দেশান্তরিত হয়ে যান ফলে মেধা পাচারের মতো দুঃখজনক ঘটনা ঘটে থাকে।
- বেকারত্ব বা কর্মসংস্থানের অভাব- ছোট্ট একটি আমাদের বাংলাদেশ। এখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি শিক্ষিত উচ্চশিক্ষিত বা কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি বর্গের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ জনসংখ্যার অনুপাতে অনেক কম তাই বেকারত্ব ও কর্মসংস্থানের অভাবের কারণে মেধা পাচার হয়ে থাকে
- আবহাওয়া ও জলবায়ুগত পরিবর্তন এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এর কারণে কিছু সংখ্যক লোক এই দেশ থেকে অন্য দেশে পাচার হয়ে যায়
মেধা পাচারের ফলাফল বা মেধা পাচারের অপকারিতা
মেধা পাচারের কারণ যাই হোক না কেন, মেধা পাচারের ফলাফল কোন একটি দেশ, সমাজ বা জাতির জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর। মেধা পাচার অর্থ পাচারের তুলনায় কোন অংশেই কম ক্ষতিকর নয়। বরং অনেক অংশেই অর্থপাচারের তুলনায় মেধা পাচার একটি দেশের জন্য বেশি ক্ষতি বয়ে নিয়ে আসে। মেধা পাচারের ফলে একটি দেশ অন্তঃসারশূন্য হয়ে পরে।
নিচে মেধা পাচারের অপকারিতা বা মেধা পাচারের ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
- মেধা পাচারের ফলে দেশ তার দক্ষ জনবল হারায়
- রাষ্ট্র মেধাশূন্য হয়ে পরে
- প্রতিরক্ষা বাহিনী, সচিবালয় থেকে শুরু করে সকল স্তরে মেধার ঘাটতি দেখা দেয়
- মেধা পাচারের কারণে একটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে
- মেধা পাচার হয়ে গেলে যোগ্য কৃষিবিদ ডাক্তার এবং প্রকৌশলীর ঘাটতি দেখা দেয়
- জিডিপির উপরে নেগেটিভ প্রভাব প্রভাব ফেলে এই মেধা পাচার
- রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়
মেধা পাচার প্রতিরোধের উপায়
- বিশ্ববিদ্যালয়, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে নিয়োগের ব্যাপারে স্বচ্ছতা এবং সততা অবলম্বন করতে হবে এই ক্ষেত্রে মেধাবীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে
- সকল স্তরে ঘুষ ও দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। এতে করে মেধা পাচার কিছুটা রোদ হবে।
- প্রাচীন আমলের শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে সমস্ত বিষয়ে উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণা করা হয়, আমাদের দেশে সেই সকল সুযোগ-সুবিধা নেই। ওই সমস্ত উন্নত বিশ্বে যুগোউপযোগী এবং আধুনিক ও জীবনমুখী শিক্ষা প্রদান করা হয়।
- সরকারি চাকরিতে দেখা যায় একজন ডাক্তার বা প্রকৌশলী বা টেকনিশিয়ান একই গ্রেডের হলে একই বেতন এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু একই গ্রেডে কর্মরত থাকা অবস্থায় দুইজন ব্যক্তির আউটপুট বা কর্মের ফলাফলে অনেকটাই কম বেশি থাকতে পারে। সেই ক্ষেত্রে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পদমর্যাদার সুযোগ সুবিধা কমবেশি করে দেওয়া উচিত।
লেখকের মতামত সম্পর্কে পড়ুন
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা রয়েছে, তার মধ্যে মেধা পাচার একটি অন্যতম জাতীয় সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানের জন্য যেমন আমাদের মানসিকতার পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে, তেমনি জাতীয়ভাবে সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে দেশ একটি মেধাশূন্য রাষ্ট্রে পরিণত হবে। মেধা শূন্যতা একটি রাষ্ট্রকে পরাধীন জাতিতে রূপান্তরিত করতে পারে।
বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে যে মেধা শূন্যতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তাহা ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল থেকে আমরা জানতে পারি। যদি এইরকম অবস্থা বিরাজ করে, তাহলে আগামী ১০- ২০ বছর পরে এই রাষ্ট্রে কোন মেধা সম্পন্ন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার তৈরি হবে না, যা হবে জাতির জন্য হুমকির কারণ
তাবিনতান ব্লগের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url