বাংলাদেশে তুলার উৎপাদন এবং তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানুন

আমাদের দেশে বছরে ৮৫ লাখ বেল তুলার চাহিদা রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশে তুলার উৎপাদন হচ্ছে মাত্র দুই লাখ বেল। ফলে চাহিদা মেটাতে বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে বিদেশ থেকে তুলা আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশে তুলার উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারলে, আমদানি বাবদ যে বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয় তার সংকোচন হবে।

বাংলাদেশে তুলার উৎপাদন এবং তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানুন

PRIMARK নামক গ্লোবাল টেক্সটাইল ব্র্যান্ডের আর্থিক বিনিয়োগে এবং Cottonconnect South Asia (pvt. ltd.) এর মধ্যস্থতায়, তুলা উন্নয়ন বোর্ডের আন্তরিক সহযোগিতায় চাষী পর্যায়ে তুলা উৎপাদনের জন্য টিএমএসএস নামক NGO কর্মসূচি সংগঠন এবং কারিগরি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।

ভূমিকা

বাংলাদেশ একটি কৃষি নির্ভর দেশ। এখানে বিভিন্ন ধরনের কৃষি ফসল উৎপাদিত হয়। খাদ্যশস্যের পাশাপাশি অর্থকরি ফসল হিসাবে পাট এবং তুলা উৎপাদন হয়। পাটকে যেমন সোনালী আঁশ বলা হয়, তুলা কে তেমনি সাদা সোনা বলা হয়। কৃষি নির্ভর দেশ হওয়া সত্ত্বেও আমাদের দেশে সর্ববৃহৎ রপ্তানি শিল্প হিসেবে গার্মেন্টস শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

আর এই গার্মেন্টস শিল্পের কাঁচামাল হচ্ছে কাপড় আর সেই কাপড় তৈরি হয় তুলা থেকে। তারপরও বাংলাদেশে তুলার উৎপাদন অতি নগণ্য। চাহিদার তুলনায় দুই ভাগ তুলাও আমাদের দেশে উৎপন্ন হয় না। তাই প্রতিবছর প্রায় সম্পূর্ণটাই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়

তুলার ইতিহাস

তুলা একটি উদ্ভিদজাত আঁশ জাতীয় দ্রব্য। জীবনধারণের জন্য আমরা উদ্ভিদের থেকে খাবার পেয়ে থাকি। তেমনি আমরা আমাদের লজ্জা নিবারণের জন্য উদ্ভিদের উপরে নির্ভরশীল। কারণ আমরা যে সমস্ত কাপড় ব্যবহার করে থাকি তা তুলা থেকে তৈরি। যদিও বর্তমান সময়ে কিছু সিনথেটিক উপাদান দ্বারা সুতা এবং কাপড় উভয়ই তৈরি হচ্ছে।

আরো পড়ুন: সড়ক দুর্ঘটনা এবং তার কারণ ও প্রতিরোধ

বাংলাদেশে উৎপাদিত তুলা থেকে যে সুতা তৈরি হয়, তা দিয়ে আমাদের পরিধেয় কাপড় চোপড় তৈরি করা হয়। তাছাড়া চিকিৎসা বিজ্ঞানে বা মেডিকেলের বিভিন্ন কাজে এই সমস্ত সুতা বা তুলা ব্যবহার করা হয়। মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রাচীনতম ফসলগুলির মধ্যে তুলা একটি অন্যতম ফসল। প্রায় সাত হাজার বছর পূর্ব থেকে এই তুলার উৎপাদন হয়ে আসছে।

তখন সিন্ধু সভ্যতায় ভারতে প্রথম তুলার আবাদ শুরু হয় বলে ধারণা করা হয়। তবে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দে নীলনদের অববাহিকায় আফ্রিকার পূর্ব সুদান অঞ্চলে এটার চাষবাস প্রসার লাভ করে। আনুমানিক চৌদ্দশ খ্রিস্টাব্দের দিকে সর্বপ্রথম তুলা শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তুলার ইংরেজি প্রতিশব্দ কটন এসেছে আরবি শব্দ কুতন থেকে।

পৃথিবীতে প্রায় ৭৫টি দেশে তুলার উৎপাদন করা হয়। এগুলোর ভিতরে ভারত, চীন, পাকিস্তান, ব্রাজিল, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র, আফ্রিকা অন্যতম। এর মধ্যে ভারত ও চীনে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে তুলা উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশে তুলার ব্যবহার এবং চাহিদা অনেক বেশি হওয়ার সত্বেও এখানে তুলার উৎপাদন কম। তাই বলা যায়, তুলা উৎপাদন এবং তার ভবিষ্যৎ অত্যন্ত লাভজনক ও ফলপ্রসু হবে।

তুলার উদ্ভিদ তত্ত্ব ও বৈজ্ঞানিক নাম

তুলা Malvaceae গোত্রের অন্তর্ভুক্ত একটি আঁশ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ফসল যাহা তুলা গাছের বীজের চতুর্দিকে আবরণ হিসেবে উৎপন্ন হয়। Gossypium herbaceum তুলার বৈজ্ঞানিক নাম। Gossypium hirsutum নামক সমতল ভূমির তুলাও আমাদের দেশে আবাদ করা হয়ে থাকে। ভবিষ্যতে গবেষণার মাধ্যমে আরো উন্নত জাতের তুলার উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা চলছে।

বাংলাদেশে তুলার উৎপাদনের ইতিহাস

অনেককাল পূর্ব থেকেই বাংলাদেশে তুলার উৎপাদন শুরু হয়। ১৯৭০ সালে আমেরিকা থেকে তুলা বীজ আমদানি করে আবাদ বৃদ্ধির কার্যক্রম চলে। ১৯৭২ সালের ১৪ ই ডিসেম্বর বাংলাদেশে তুলা উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে এর আবাদ অনেকাংশে জোরদার হয়। ১৯৭৬ সালে ডেল্টা পাইন নামক জাতের তুলা বীজ আমেরিকা থেকে আমদানি করা হয়।

বাংলাদেশের উৎপাদিত পৃথিবীর বিখ্যাত মসলিন কাপড় তৈরি হতো তুলা থেকে। এই জাতের তুলার নাম ফুটি কার্পাস। এটার বৈজ্ঞানিক নাম Gossypium arboreum var. neglecta. নারায়ণগঞ্জের দুইজন তাঁতি ২০২০ সালে পুনরায় এই মসলিন কাপড় তৈরি করতে সক্ষম হন। বর্তমানে দেশে সরকারিভাবে এই মুসলিম কাপড় তৈরি বাণিজ্যিকীকরণ চলছে।


প্রতিবছর ৭ই অক্টোবর আন্তর্জাতিক তুলা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ২০১৯ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় সর্বপ্রথম তুলা দিবস উদযাপিত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০২০ সাল থেকে বাংলাদেশে এই দিবসটি প্রতিপালন হয়ে আসছে। এক সময় বাংলাদেশ থেকে ৩২৫ জন চাষিকে পশ্চিম পাকিস্তানের নেওয়া হয়েছিল পাট চাষের জন্য।

দেশ স্বাধীনের পরে তাদেরকে দেশে নিয়ে এসে তুলা চাষের জন্য জমি বরাদ্দ দেয়া হয়। কারণ তখন থেকেই তুলা উৎপাদনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনেক ভালো কিছুই অনুমান করা হচ্ছিল। তাদের নামে ৭৯৬ একর জমি ঠাকুরগা জেলার রাণীশংকলে বরাদ্দ দেওয়া হয়। বাংলাদেশে তুলার উৎপাদন কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, যশোর ইত্যাদি জেলায় সবচেয়ে বেশি হয়। 

তবে চারঘাট সহ রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চলে নাটোর, সিরাজগঞ্জে যথেষ্ট পরিমাণে তুলার আবাদ শুরু হয়েছে। এই সমস্ত অঞ্চলে কটন কানেক্ট সাউথ এশিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের মধ্যস্থতায় এবং প্রাইমার্ক নামক গ্লোবাল টেক্সটাইল ব্রান্ডের আর্থিক সহায়তায় তুলার আবাদ প্রসার লাভ ঘটেছে। এতে তুলা উন্নয়ন বোর্ড সার্বিক সহায়তায় প্রদান করেন। 

মাঠ পর্যায়ে টি,এম,এস,এস নামক দেশ বিখ্যাত এনজিওর নিবিড় তদারকিতে চাষী পর্যায়ে মানসম্পন্ন তুলা উৎপন্ন হচ্ছে। টিএমএসএস বিগত ৪/৫ বছর যাবত এ কাজে নেতৃত্বের ভূমিকায় আছে। তাদের দক্ষ জনবলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে তুলার উৎপাদন আরো বহু গুণে বৃদ্ধি পাবে বলে সংস্থাটি আশাবাদী। 

বাংলাদেশে তুলার উৎপাদন এবং তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানুন

টি,এম,এস,এস হাইব্রিড এবং উচ্চ ফলনশীল জাতের তুলার আবাদ করিয়ে থাকেন। পাহাড়ি অঞ্চলেও যথেষ্ট পরিমাণে তুলার আবাদ রয়েছে। বিশ্বের ৭৫ টি তুলা উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪০তম।

বাংলাদেশে তুলার চাহিদা

তুলা বাংলাদেশের সাদা সোনা নামে পরিচিত। ২০২২-২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে বাৎসরিক তুলার চাহিদা ৮৫ লাখ বেল। তার মধ্যে মাত্র প্রায় দুই লাখ বেল উৎপন্ন হয় দেশে। বাদ বাকি প্রয়োজনীয় তুলা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এই সমস্ত আমদানি করা তুলা থেকে যে সমস্ত সুতা তৈরি হয় তা থেকে কাপড় তৈরি করা হয়। 


সেই সমস্ত কাপড়গুলি আবার গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহৃত হয়ে তা বিদেশে রপ্তানি হয়। এই কারণে আমাদের দেশে তুলা আমদানির চাহিদা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম তুলা আমদানিকারক দেশ। ১৯৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশের চাহিদার প্রায় ২০ ভাগ তুলা উৎপাদনের জন্য সরকার বিভিন্ন কর্মপদ্ধতি হাতে নিয়েছেন।

তাই বাংলাদেশের তুলার উৎপাদনের ভবিষ্যৎ সুস্পষ্ট। এই সমস্ত কর্মপদ্ধতির মধ্যে রয়েছে আড়াই লাখ হেক্টর জমি নির্বাচন। গবেষণার মাধ্যমে তুলার জাতের উন্নয়ন, বিটি কটনের ট্রায়াল ইত্যাদি।

বাংলাদেশে তুলা উৎপাদনের অর্থনৈতিক গুরুত্ব

আমাদের দেশের বার্ষিক জিডিপির ১১.১৬ ভাগ আসে বস্ত্র খাত থেকে। আর এই বস্ত্র উৎপন্ন হয় তুলা থেকে, যার অধিকাংশই আমদানি করতে হয়। আমাদেরকে যদি তুলা আমদানি করতে না হত বা কম করতে হতো তাহলে আমাদের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় কম হত। তুলা আমদানিতে বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে।

সুতরাং বাংলাদেশে তুলা উৎপাদনের ভবিষ্যৎ অনেক ভালো এবং অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। তাহলে এতটাই গুরুত্ব বহন করার পরেও কেন বাংলাদেশে তুলার আবাদ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে না তার অনেকগুলি কারণ রয়েছে। প্রিয় পাঠক বৃন্দ, এই সকল কারণগুলোর মধ্যে কিছু কারণ নিম্নে আলোচনা করা হলো-

  • তুলা একটি উচ্চভূমির ফসল। ফলে এ দেশের সকল জমিতে তুলার আবাদ করা সম্ভব না
  • তুলা উৎপাদন এলাকায় বৃষ্টিপাত কম হওয়া প্রয়োজন
  • জলবায়ু পরিবর্তন এ দেশের তুলা আবাদের জন্য একটি প্রধান অন্তরায়
  • প্রায় ৮মাসের ফসল হওয়ায় ফসল আবাদের নিবিড়তা কমায়

তুলা উৎপাদনের ভবিষ্যৎ

বাংলাদেশ খরিফ-২ এ মোট আবাদি জমির মাত্র ০.৫২ শতাংশ জমিতে তুলার আবাদ হয়ে থাকে। তুলা গাছ থেকে যেমন তুলা পাওয়া যায়, তেমনি তার বীজ পাওয়া যায়। এই তুলা বীজের প্রায় ১৫-২০ ভাগ ভোজ্য তেল পাওয়া যায় এবং উচ্চ প্রোটিনসম্পন্ন খৈল পাওয়া যায়। যাহা পশু খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই খৈইলে প্রোটিন থাকে প্রায় ২৫ ভাগ।

ফ্যাট থাকে ২২ থেকে ২৪ ভাগ এবং প্রায় ৪০-৪২ ভাগ থাকে ক্রড ফাইবার। ফলে এই খৈল উচ্চমান সম্পন্ন পশু খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তুলার গাছকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। সুতরাং ফসল হিসেবে তুলাবাদ সবদিক থেকেই লাভজনক। তাছাড়া গার্মেন্টস শিল্পে বা পোশাক খাতে আমাদের ব্যাপক রপ্তানি রয়েছে।


সেই রপ্তানিকে টেকসই করতে আমাদের কাপড়ের প্রয়োজন। এভাবে আমরা বলতে পারি যে, আমাদের দেশে তুলা উৎপাদনের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় সংকোচন সম্ভব। এখান থেকে আমরা তুলা উৎপাদনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পেতে পারি। তাছাড়া বাংলাদেশের জলবায়ু এবং আবহাওয়া তুলা চাষের জন্য যথেষ্ট উপযোগী।

বাংলাদেশের আবহাওয়া এবং জলবায়ু তুলা চাষের জন্য যতটুকু উপযোগী, আমরা যদি ততটুকুকে সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে তুলা উৎপাদন করতে এগিয়ে আসি, তাহলে ২০৪১ সাল নাগাদ আমাদের যে পরিকল্পনা রয়েছে তাহা বাস্তবায়ন সম্ভব।

লেখক এর মতামত

আমাদের দেশে তুলা আবাদের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় সংকোচন করার সুযোগ রয়েছে। তাই তুলার আবাদকে চাষী পর্যায়ে জনপ্রিয় করতে হবে। চাষী পর্যায়ে লাভজনক করতে হলে গবেষণার মাধ্যমে উন্নত জাতের তুলা আবিষ্কার করতে হবে। তাছাড়া আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি বড় খাত হচ্ছে গার্মেন্টস শিল্প।

সেই গার্মেন্টস শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে আমাদের তুলার প্রয়োজন, যা সম্পূর্ণটাই প্রায় আমদানি নির্ভর। এই আমদানি নির্ভরতা কমানোর জন্যই আমাদেরকে তুলা আবাদের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। উপরের আলোচনা থেকে আমরা বলতে পারি যে, বাংলাদেশে তুলা উৎপাদন এবং তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের আর কোন কিছু জানার বাকি রইল না। 


-লেখক একজন কৃষিবিদ

তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট এবং বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকার খবর।




এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

তাবিনতান ব্লগের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url